বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩১ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
টেকনাফ ছাড়াও এবার নতুন করে উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ চকরিয়ায় জেলা পরিষদের জমিতে নির্মিত আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও জাহাজ ছাড়ার পয়েন্ট নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি গঠণ সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে কক্সবাজার শহরে এসে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসির সড়ক অবরোধ পাহাড়ী আস্তানা থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে শিশুসহ ৩১ জন উদ্ধার, দুই দালাল আটক সাবের মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর পিএস ফিরোজ কক্সবাজারে গ্রেপ্তার মিয়ানমারের বাঘগুনা খালের পাশে রয়েছে নিমার্ণ সামগ্রী ও দুইটি ট্রলার, মাঝি-মাল্লা সহ ১১ জনের হদিস নেই মিয়ানমারের উপজাতি সম্প্রদায়ের ৬৫ নাগরিকের অনুপ্রবেশ চকরিয়ায় কিশোরকে ছুরিকাঘাত : আটক ৪ চকরিয়ায় ফেরিওয়ালার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের প্রয়াণ অপূরণীয় ক্ষতি

রুমীন ফারহানা

একজন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ নানামাত্রিক পরিচয়ের মানুষ। শুধু একজন শিক্ষাবিদ হিসেবেও তিনি এই দেশের ইতিহাসে অমর হতে পারতেন। একজন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু ছাত্রছাত্রীকে তার জ্ঞানে আলোকিত করেছেন। শুধু তা-ই না, তার লিখিত ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা’ বইটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অ্যাকাডেমিক ছাত্র নয়, এমন বহু আগ্রহী পাঠককে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞানে আলোকিত করেছে।
শিক্ষকতার পর চার বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত কয়েক বছরে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন, তাদের দেখলে উপাচার্য পদটার প্রতি এক ধরনের বীতশ্রদ্ধ ভাব তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক অতীতে তিনি ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন উপাচার্যের একজন, যিনি সেই আসনটির সত্যিকার সম্মান রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
গবেষক-পর্যালোচক হিসেবেও উল্লেখযোগ্য পরিচয় আছে অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের। তিনি আমৃত্যু তুলনামূলক রাজনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে গবেষণা করে গেছেন। তার লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির অধিক। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে তার প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক। তার এসব কাজ এই জাতির অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে অনাগত দিনেও।
একজন শিক্ষাবিদ এবং পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবেই তিনি অমর হয়ে থাকতে পারতেন। একজন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল সব রাজনৈতিক দল থেকে দূরত্ব রেখে তার কথা বলে যাবেন এবং সেটা দিয়ে সমাজ বিবর্তনে প্রভাব রাখবেন এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি। আবার কেউ কেউ কখনও কখনও ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে তার যে মতাদর্শ সেটা বাস্তবায়নের জন্য কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে কিছুটা নৈকট্য বজায় রাখাটাকে বেশি যৌক্তিক বলে মনে করেন। জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ড. এমাজউদ্দীন তাই একটা সময়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নৈকট্যে এসেছিলেন। সেটা এই দলটির জন্য ছিল এক অসাধারণ আশীর্বাদ।
কারও বিবেচনায় তার এই পদক্ষেপ বোকামি নিশ্চয়ই। কোনও একটা বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি দূরতম কোনও যোগাযোগও এই দেশে শুদ্ধতম মানুষটাকেও বিতর্কিত করে। যার ফলস্বরূপ তিনি শিকার হন প্রতিপক্ষের আক্রমণের‌। অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের মতো মানুষও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। দলের পক্ষে প্রপাগান্ডা চালানো অনলাইন পোর্টালগুলো তাঁর বিরুদ্ধে নোংরা কথা বলেছে। এই ঝুঁকি নিয়েও তিনি পরোক্ষভাবে হলেও দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে রাজনীতির সাথে সংযুক্ত থেকেছেন। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর জন্য বিষয়টি আস্বাভাবিকও নয়।  
ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর জ্ঞান অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরামর্শ দেওয়াসহ নানাভাবে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে তো সাহায্য করেছেন‌ই, পরে তিনি জাতীয়তাবাদী চেতনার বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীদের ‘শত নাগরিক কমিটি’ নামের এক প্ল্যাটফর্মে এনে দেশ এবং জাতির স্বার্থে কাজ করানোর জন্য চেষ্টা করে গেছেন। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর দেশের মানুষের ওপর চরম কর্তৃত্ববাদী শাসন চেপে বসার প্রেক্ষাপটে এই নাগরিক কমিটি চাপ প্রয়োগকারী সামাজিক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।  
এই দেশে নানা বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীর রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকা প্রায় সব বুদ্ধিজীবী দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করেন; টিভি টকশোতে আমার নিজের সেই অভিজ্ঞতা হচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু আলোচ্য মানুষটির সাংস্কৃতিক মান এই দেশের সাধারণ মাপের তুলনায় অনেক উঁচুতে। অত্যন্ত মৃদুভাষী, সদালাপী, উদার মনের মানুষটি তাঁর এই গুণের জন্যও আলোচিত হবেন আরও বহুকাল।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন স্যারের প্রয়াণ ব্যক্তি আমাকে অনেক বেশি গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। কারণ, তাঁর সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন আমার ছোট চাচা মো. আমিরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। প্রয়াত আমিরুজ্জামান সাহেব সিএসপি অফিসার ছিলেন, যাকে অলি আহাদের ভাই হওয়ার অপরাধে তৎকালীন সরকার সচিব পদে পদায়ন না করায় তিনি চাকরি ছেড়ে জাতিসংঘে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত হন। তার পোস্টিং ছিল রোমে। তিনি ঢাকায় এলে আমাদের ধানমন্ডির বাসাতেই বেশিরভাগ সময় থাকতেন। তখন তার সাথে দেখা করতে, গল্প করতে নিয়মিত আসতেন এমাজউদ্দীন চাচা। ছোট্টবেলা থেকে তার স্নেহ, ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি আমি। পরবর্তী জীবনে যখন রাজনীতিতে পা দেই তখনও তার স্নেহ, আশীর্বাদের হাত সবসময়ই ছিল আমার মাথার ওপর। আমার বাবার মৃত্যুর পর ‘অলি আহাদ স্মৃতি সংসদ’-এর আহ্বায়ক হয়েছিলেন তিনি।  
বহুবার বহু কাজে কিংবা অকাজে গিয়েছি তার কাছে। ফোন করেছি যখন তখন। ফোন ধরেই বলতেন, ‘বলো মা…’। মা বলেই ডাকতেন আমাকে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল এই স্নেহের বন্ধন। ছোট্টবেলা থেকে দেখেছি ধীর, স্থির, শান্ত, মৃদুভাষী, সদালাপী, মুখে মৃদুহাসি। মানুষটি যে কঠোর হতে পারেন মনে হয়নি কখন। অথচ প্রয়োজনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি মুহূর্তমাত্র।  
১৯৯৬ সালে একজন প্রভোস্ট নিয়োগকে কেন্দ্র করে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেকের সাথে মতবিরোধের জের ধরে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রভোস্ট নিয়োগের একক ক্ষমতা উপাচার্যের। সেখানে সঙ্গত কারণেই তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেকের অযাচিত হস্তক্ষেপ ক্ষুব্ধ করেছিল তাকে। অথচ এই বিষয়ে ন্যূনতম অভিযোগের তীর কারও প্রতি নিক্ষেপ করেননি তিনি। এমনই ছিল তার ভদ্রতাবোধ। পদত্যাগের কারণ হিসাবে সবসময়ই তিনি বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালানোর স্বার্থেই তার এই পদত্যাগ। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আজকের উপাচার্যদের কথা শুনলে বা তাদের কাণ্ডকীর্তি দেখলে একজন এমাজউদ্দীন স্যারকে চেনা কঠিন হবে। তার সময়ে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল শক্তহাতে ধরেছিলেন তিনি। ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ বলে কোনও পরিচয় তিনি জানতেন না। তার কাছে সবার একটাই পরিচয়, তা হলো ছাত্র। তার চরিত্রে বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতার সাথে অপূর্ব মিশেল ঘটেছিল দৃঢ়তা, ঋজুতা আর সততার এক অপূর্ব শক্তির। দল, মত নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধাভাজন হওয়া আমাদের মতো দেশে খুব সহজ ছিল না। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই অবলীলায় করেছেন তিনি। 
‘তাঁর অভাব কোনোদিন, সহজে পূরণ হবে না’ অনেক মানুষের মৃত্যুর পর বহুল শ্রুত এই কথাটি আমার মনে হয় আমরা খুব সহজেই ব্যবহার করে ফেলি। মৃত্যুর পর আবেগাপ্লুত হওয়া আমাদের এই ধরনের বাক্য অবশ্য ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে কোনও দিন বা খুব সহজে অভাব পূরণ হয় না এমন মানুষ বিশ্বেই খুব বিরল। তবে আমি বিশ্বাস করি, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সেই খুব বিরল মানুষদের একজন, যাঁর সাথে ‘তাঁর অভাব কোনোদিন পূরণ হবে না’ কথাটা খুব অসাধারণভাবে মিলে যায়।
তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর শিক্ষা, দর্শনে আলোকিত হোক আরও বহু প্রজন্ম। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।  জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

( লেখাটি বাংলা ট্রিবিউন থেকে সংগৃহিত )

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888